top of page

মানুষ পেলে আর ইলিশ মাছ খায় না

  • Writer: Subhadeep Ghoshal
    Subhadeep Ghoshal
  • Apr 17, 2021
  • 4 min read

Updated: May 3, 2022


প্রিয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন


বাংলা ভাষার এই এক মাধুর্য আসছি বলে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায় ....


একই শব্দের এরকম বিপরীতধর্মী দুটি মানে বিস্ময় জাগায় অবশ্যই, যদিও যে প্রেক্ষিতে, যাকে বলা হয় তাতে মানেটা তার বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না। কিছুটা ইংরেজি ঘেঁষা চলিত বাংলায়, একই শব্দকে প্রশ্ন এবং উত্তর হিসেবে ব্যবহারের অপূর্ব উদাহরণ আমরা পাই “ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা” গ্রন্থে। শিবরাম সেখানে তাঁর মায়ের বর্নিত অনন্ত অসীম ঈশ্বরকে অনুভব করার আধ্যাত্মিক অনুভূতিটিকে, সদ্যই রিনিকে চুমু খাওয়ার স্বর্গীয় মাধুর্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেবার আপ্রান চেষ্টা করছেন কিন্তু মাকে মুখে সরাসরি বলতে পারছেন না। মা ও ছেলের সেই অনবদ্য কথোপকথন শেষ হয় এইভাবে –


মা : কিসের কথা বলছিস তুই?

শিবরাম : কিসের কথাই তো বলছি মা!


এক্ষেত্রে যদিও মায়ের কাছে ব্যাপারটা প্রচ্ছন্ন থাকে, ঘটনা পরম্পরার সাক্ষী পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না, শিবরাম কিসের কথা বলছেন। একক শব্দের দুই রকমের মানের আরেকটি উদাহরণ আমার ব্যক্তিগত। কোথায়, কবে সঠিক মনে নেই – সম্ভবত দশ এগারো বছর আগে ট্যাংরার দিকে – গাড়ীতে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি পাশে একটি স্কুটারের পিছনে বসে, একটি মেয়ে, হাতে খোলা বই বা খাতা থেকে কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করছে। হয়তো পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে টেনশনে, ভুলে যাওয়া কোন উত্তরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। নিঃসন্দেহে চলন্ত স্কুটারে বসে এরকম প্রচেষ্টা খুবই বিপদজনক। আমি নিজে যদিও নানান অস্থানে কুস্থানে বই পড়ে থাকি – কিন্তু এই রকম দুঃসাহসিক পাঠপ্রচেষ্টা আমিও মেনে নিতে পারি নি। যারপরনাই বিচলিত হয়ে পড়ে গৃহিণীকে বলি –


দেখো দেখো! মেয়েটা পড়তে পড়তে যাচ্ছে, পড়ে যাবে তো!


ভিড় রাস্তায় মূল চরিত্রটি দৃষ্টির অগোচরে চলে যায় মুহূর্তের মধ্যেই। আর আমি, ঘটনাটির থেকেও আমার মুখনিঃসৃত সংলাপে বাংলা শব্দের এই দ্বৈত সত্তার বিন্যাসে বিস্মিত হয়ে বসে থাকি। একটি শব্দ যেমন সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা যায়, একটি বাক্যের মধ্যেও যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অর্থ অন্তর্নিহিত থাকতে পারে তার একটি উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা হয় আমার কৈশোরে। সম্ভবত আশির দশকের প্রথম দিকে শারদীয় দেশ পত্রিকায় পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখা একটি কবিতার শিরোনাম ছিল –


মানুষ পেলে আর ইলিশ মাছ খায় না


তখন শারদীয়া হাতে পেলে প্রথমে পাতা উল্টে দেখে নেয়া হতো। পরিবারের যে যার নিজের পছন্দমত পদ্য, গল্প, প্রবন্ধ নির্বাচন করে রাখত পরে পড়ার জন্য। সেইমত পাতা ওলটাতে গিয়ে, উক্ত কবিতার শিরোনামটি, আমি মা এবং দাদা তিনজনেরই নজরে আসে এবং যে যার নিজের মতো মানে করে নিয়ে পাতা উল্টে এগিয়ে যাই। কবিতাটি কেউই তখন পড়ে দেখিনি। কিছুদিন পরে আলোচনা প্রসঙ্গে শিরোনামটি উঠে আসে এবং আবিষ্কৃত হয় আমরা তিনজন, তিনরকম মানে করেছি। আমি কৈশোর সুলভ ঔৎসুক্যে ধরে নিয়েছিলাম এটি কোন কল্পজগতের বিবরণ যেখানে ইলিশের প্রিয় খাদ্য মানুষ, আর নিতান্তই মানুষ না পেলে তারা অন্য ছোট মাছ খায়। মা সেলিব্রিটিদের নাড়ি নক্ষত্রের খবর রাখতে পছন্দ করেন, তাই ভেবে নিয়েছিলেন এখানে মানুষ পেলে বলতে ফুটবলার পেলের কথা বলা হয়েছে। যিনি এতদিন ইলিশ মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন, এখন কোনো অজ্ঞাত কারণে ওনার ইলিশ মাছের প্রতি অরুচি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ – মানুষ Pele আর ইলিশ মাছ খায় না । দাদা তখন চাকরির পাশাপাশি রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে চর্চায় ব্যস্ত, তাই ভেবেছিল এখানে চাহিদা এবং যোগানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যতক্ষণ ইলিশ মাছ পায় না ততক্ষণ খাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। তারপর যখন ইলিশ মাছ খুবই সহজলভ্য হয়ে যায় তখন তার খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়। অতঃপর কবিতাটি পড়া হয় এবং দেখা যায় এর কোনটাই ঠিক নয়, কারণ শেষ দুটি লাইন ছিল এরকম –


কলকাতার মতো বড়-বড় বৈদ্যুতিক শহর

এখন মানুষ পেলে আর ইলিশ মাছ খায় না।


অর্থাৎ নগর জীবন মানুষকে খেয়ে ফেলছে। এই সব বিশালাকৃতির শহরগুলিকে বিশাল এক মাংসাশী প্রাণীর তুল্য মনে করেছেন কবি, যার প্রিয় খাদ্য মানুষ। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে শিরোনামটিতে একমাত্র পেলে শব্দটি ছাড়া আর বাকি সব শব্দের নিজস্ব অর্থ চারটি ক্ষেত্রেই এক। আমরা তিনজনই নিজেদের পছন্দমত একটা মানে করে নিয়েছি অথচ উদ্দিষ্ট অর্থটি সম্পূর্ণ কবিতাটা না পড়লে বোঝার উপায় নাই।

এইসব পুরোনো স্মৃতি হঠাৎ একসঙ্গে মনে এল, সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার পড়ে। ভারতীয় জনতা পার্টির জনপ্রিয় বাঙালি নেতা শ্রী দিলীপ ঘোষের সাক্ষাৎকার। দিলীপবাবুর বক্তব্য যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত এবং কিছুটা মার্জিতই মনে হয়েছে। যেসব উগ্র বক্তব্যের জন্য উনি সমাজের একটি অংশের মানুষের কাছে অপ্রিয় আমি এই সাক্ষাৎকারটিতে অন্তত সেরকম আপত্তিজনক কিছু খুঁজে পাইনি।


ব্যক্তিগতভাবে আমি ওনার মত ও পথের শরিক নই এবং ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা, রাজ্য এবং দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে

ree

যথেষ্ট ক্ষতিকর বলেই মনে করি, তা সত্ত্বেও অন্তত এই ক্ষেত্রে দিলীপবাবুর বক্তব্যে আমি সেরকম কোনো অশনি সংকেত পাইনি। তবে মঞ্চে, পথসভায়, টেলিভিশন বিতর্কে, হালকা আলাপচারিতায় দিলীপবাবু এবং ওনার সহধর্মী নেতা, কর্মী এবং প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ সমর্থকদের বক্তব্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বেশ কিছু অংশ মেলাতে না পেরে আমি বিষ্মিত। সর্বোপরি দুটি প্রশ্নের উত্তরে আমি সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্ত। দিলীপবাবু জানিয়েছেন –


১. মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় মুসলিমদের তোষণ করেছেন, এখন শোষণ করছেন।

২. পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হি্ংসার সবচেয়ে বড় শিকার মুসলিমরা। বিজেপি ক্ষমতায় এলে এটা হবে না। মুসলিমরাও এটা বুঝছেন।


আনন্দবাজার পত্রিকা শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছে সাক্ষাৎকারটি শীতলকুচিতে নির্বাচনজনিত হিংসা পাঁচটি প্রাণ কেড়ে নেওয়ার কিছুদিন আগের। এই সাক্ষাৎকারের আগে-পরে দিলীপবাবুদের বক্তব্যের সঙ্গে এই দুটি উত্তর কোনভাবেই মেলাতে পারছিলাম না। তারপরই মনে হল একই শব্দের এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বাক্যের কত রকম মানে হয় সেতো কবে থেকেই জানি। এবং তারপরই এইসব কথার অনেক রকম মানে মনে উঁকি দিল। তার মধ্যে কোনটা ঠিক, অথবা কোনোটাই ঠিক না হয়ে সম্পূর্ণ অন্য কোন মানে আছে কিনা তা পুরো চিত্রনাট্যটি না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়।


আগামী দোসরা মে হোক বা তার কিছু দিন পরে, সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বা অন্য উপায়ে, ভারতীয় জনতা পার্টি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে চলেছে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সম্পূর্ণ চিত্রনাট্যটি আমরা তারপরই জানতে পারব, দিলীপবাবুর বক্তব্যের প্রকৃত অর্থ তারপরেই পরিষ্কার হবে। তবে সে অর্থ যাই হোক না কেন, এই সাক্ষ্যাৎকার এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন সংক্রান্ত অন্যান্য ছোটো বড় বিভিন্ন ঘটনায় আমার ব্যাক্তিগত প্রাপ্তি এটাই – চার দশক আগে প্রকাশিত পূর্ণেন্দু পত্রী মহাশয়ের কবিতার শিরোনামটির সময়োপযোগী একটি পাঁচ নম্বর মানে আমি খুঁজে পেয়েছি –


জনপ্রিয়, শক্তিশালী, রাজনৈতিক দলগুলি

এখন মানুষ পেলে আর ইলিশ মাছ খায় না।


১৭ই এপ্রিল, ২০২১

সাহায্যসূত্র ও ঋণস্বীকার

১ আজ আছি, কাল নেই , সুভাষ মুখোপাধ্যায়

২ ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালবাসা , শিবরাম চক্রবর্তী

৩ মানুষ পেলে আর ইলিশ মাছ খায় না ,পূর্ণেন্দু পত্রী

৪ ভোটে না জিতলে কি আদর্শ জলে ধুয়ে খাব ? - দিলীপ ঘোষের সাক্ষ্যাৎকার, আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫ এপ্রিল ২০২১


Image Credit "IMG_0278" by bdgamer is marked with CC BY-NC-SA 2.0.

Comments


Anchor 1
bottom of page