পেরিয়ে এলাম চুয়ান্ন
- Subhadeep Ghoshal

- Feb 12
- 3 min read
ইদানীং আমার চুলে পাক ধরেছে। রাস্তাঘাটে, দোকানে বাজারে এখন অনেকেই জেঠু বলে ডাকছে। বাড়ছে নিজের মুখের রেখায় আজব ত্রিকোণমিতির আঁকিবুঁকি। ছেলেবেলার স্মৃতি জড়ানো মুখগুলো একে একে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাবা চলে গেছেন অনেক আগেই। মায়ের না থাকাও দু বছর গড়ালো। কাকা, জ্যাঠা, মামা, মাসী, পিসি, পিসেমসাই, কাকিমা, জেঠিমা, মামীমা ডাকার মতো মানুষদের সংখ্যা এখন এক আঙুলেই গোণা যায়। এমন কি গত বছর স্কুলের এক সহপাঠীও ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আচমকা সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরের দিন দুপুরেই পাল্স্ রেটের লাইন যখন সরলরেখা হয়ে গেল, তখন আমি আইসিসিইউ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে। তার পর থেকেই মনে হচ্ছে, আমার ভবের খেলাই যে আর কতদিন তাই বা কে জানে। সম্প্রতি হাতে এল নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণানের লেখা বই "Why We Die”। ভাবলাম পঞ্চভূতে মিশে যাওয়ার আগে বইটা পড়ে নেওয়া উচিত। বইটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শিরোনাম "Live Fast and Die Young”, সেটি শুরু হচ্ছে এইভাবে
“In springtime, my wife and I will often take a walk in Hardwick Wood near Cambridge to see the riot of bluebells that cover the forest ground. Once, we were walking along a path when we came upon a stone monument commemorating Oliver John Hardiment, a young man who died in 2006 at the age of twenty-five. Below his name was a quotation from the Indian writer Rabindranath Tagore: "The butterfly counts not months but moments and has time enough."
ভেঙ্কি এরপরে জানিয়েছেন প্রজাপতি সাধারণত এক মাসের বেশী বাঁচে না। বুঝলাম সে কারণেই প্রতিটি মুহূর্তের গুরুত্ব সে বোঝে। আমরা জীবনকে বছরে হিসেব করি তাই হাতে সময় আমাদের সময় বেশী থাকে না। সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন কবিতা বা কোন গানে এরকম একটি লাইন আছে সেটা কিছুতেই মনে পড়ল না। একবার ভাবলাম চ্যাট জিপিটিকে শুধাই। কিন্তু "প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং" এখনও সেভাবে আয়ত্ত হয় নি, তাই এক বাঙালী কবির বাংলা লেখার ইংরিজি অনুবাদ থেকে মূল লেখাটি তাকে কিভাবে খুঁজতে নির্দেশ দেবো ভেবে পেলাম না। অবশেষে প্রাচীন পদ্ধতিতে বহুক্ষণ গুগুল সার্চ করার পর খুঁজে পেলাম সে কবিতা। কবির চীন জাপান ভ্রমণের সময় থেকে পাখা, কাগজে, রুমালে কিছু লিখে দেবার জন্যে লোকের অনুরোধ মেটাতে যেসব টুকরো লেখার সৃষ্টি, নামহীন সেইসব কবিতা একত্র করে ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল “লেখন” কাব্যগ্রন্থ। ছাপার অক্ষরের পরিবর্তে কবির হস্তাক্ষরে ছাপা সেই বইয়ের তৃতীয় কবিতা এটি
প্রজাপতি সে তো বরষ না গণে,
নিমেষ গণিয়া বাঁচে,
সময় তাহার যথেষ্ট তাই আছে।।
আমাদের জীবনের চাওয়া পাওয়ার প্রতিটি মুহূর্তই এখন স্মার্টফোন আর সোশাল মিডিয়ার কুহক জড়ানো। কেউ কেউ তবু মাথা তুলে অন্যরকম হতে চাওয়ার সাহস দেখাতে পারে। অমলকান্তি যেমন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। আমি ছাপোষা কিম্ভূত, আমার প্রজাপতি হতে চাওয়ার সাহস নেই। সুতরাং আমাকে বছর গণিয়াই চলতে হবে এবং সময়ও যথেষ্ট নাই। গুনে দেখলাম আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আমার বয়স হবে চুয়ান্ন। ইদানীং নিজের ঢাক নিজে বাজানোর নানারকম সুব্যবস্থা হয়েছে। অবশ্য আপনি যদি “প্রভাবশালী”, ”কাজের মানুষ কাছের মানুষ”, সার্বজনীন “নিজের মেয়ে” অথবা ঈশ্বর প্রেরিত “বিশ্বগুরু” জাতীয় কেউ হন তাহলে আপনার জন্মদিনে বা অন্য ৩৬৪ দিনে অসংখ্য গুণমুগ্ধ আপনার হয়ে জয়ঢাক বাজিয়ে ঢাকের ছাল চামড়া তুলে ফেলবে। আমার সে সৌভাগ্য হবার সম্ভাবনা নেই। তাই আমার ঢাক আমাকেই পেটাতে হবে। অগত্যা আমার বয়স আরও এক বছর বেড়ে যাওয়ার সুখবরটি দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চুয়ান্নতম জন্মদিনের প্রাক্কালে আমার এই সামান্য নিবেদন - "পেরিয়ে এলাম চুয়ান্ন"

এই যে আমার ক্ষুদ্র জীবন নগণ্য
ইচ্ছেরা সব রইল জমা অপূর্ণ
ডাকলে পথে বললে না তো কি জন্য
তোমার সাথে আমার চলা অনন্য
পরশপাথর খুঁজব ভেবে পথ হারালাম
দখিন হাওয়া বলল "শুধু ভালবাসিস”
ডাক নামেতে ডাকত প্রিয় যেসব সুজন
বলল "ছুঁতে পারবি না আর, আব্বুলিশ"
"আমরা এখন মায়ার নিশীথ তারার দেশে
পথের ম্যাপে পাবিনা আর তার হদিশ
চিলেকোঠায় জমিয়ে রাখা স্মৃতির ঘুড়ি
ইচ্ছে হলে ছাদে উঠে উড়িয়ে নিস”
সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এলাম
সামনে এখন বৃষ্টি ভেজা অরণ্য
আমার চলা হয়তো বাকি আর কিছু পথ
পায়ে পায়ে পেরিয়ে এলাম চুয়ান্ন।
১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
সাহায্যসূত্র এবং ঋণস্বীকারঃ






Comments