top of page

উত্থান ও পতন

  • Writer: Subhadeep Ghoshal
    Subhadeep Ghoshal
  • Oct 19, 2023
  • 7 min read

Updated: Oct 20, 2023


ree











শিরোনামটি দেখে আপনারা যদি অন্য কিছু ভেবে বসেন তাই আগেভাগেই বলে রাখি, গূঢ় কোনো উত্থানের উত্তেজনা অথবা পতনজনিত সংকটের সমাধান এ লেখায় আশা করবেন না।


অবশ্য এই সাবধানবাণী সত্ত্বেও ভুল বোঝার কিছু সম্ভাবনা থেকে যায়। আপনাদের মনে হতেই পারে যে উত্থান ও পতন সম্পর্কিত বিভিন্ন জগদ্বিখ্যাত বই, যথা "রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন" বা "তৃতীয় রাইখের উত্থান ও পতন" অথবা "তৃতীয় শিম্পাঞ্জির উত্থান ও পতন" - শিরোনামটি এরই কোন একটির থেকে অনুপ্রাণিত। এটাও মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে এই উত্থান পতন আসলে সাম্প্রতিক ও বহু আলোচিত কোনও বিষয় - যেমন চন্দ্রযানের গৌরবময় উত্থান এবং চাঁদের মাটিতে মর্মস্পর্শী পতন, অথবা মোট জিডিপির মাপকাঠিতে পঞ্চম স্থানে উঠে আসা আর প্রেস ফ্রিডম সূচকের তলানিতে নেমে যাওয়া, নতুবা টম্যাটোর দামের মূল্য বৃদ্ধি আর মোবাইল ডেটার মূল্য হ্রাস ইত্যাদি।


কিন্তু না, এসবের কোনটাই আপনারা এই লেখায় পাবেন না।


আমি সামান্য কিম্ভুত, আদার ব্যাপারীদেরই খবর রাখি না, এসব জাহাজের খবর নিয়ে আলোচনা আমার সাধ্যের বাইরে। এই উত্থানপতনের আখ্যান নেহাতই ব্যক্তিগত। তবে সে ক্ষেত্রেও রকমফের থাকতে পারে তাই আরো একটু পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। পরীক্ষায় প্রথম হওয়া বা ফেল করা, চাকরি পাওয়া বা চাকরি যাওয়া, মিউচুয়াল ফান্ডে লক্ষী লাভ বা আর্থিক প্রতারণায় অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হওয়া - এইধরনের উত্থান পতনের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত হলেও মূলত আর্থ সামাজিক এবং এক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য।


আমার এই লেখার বিষয় মানবশরীরের আকস্মিক ভূমিশয্যাগ্রহণ। মানে যাকে বলে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাওয়া। বোরোলিনের সেই বিজ্ঞাপন যেখানে আমরা দেখি সাইকেল চালানো‌ শিখতে গিয়ে বাচ্চাটি অল্প চোট পেয়েছে, দাদু তুলে ছড়ে যাওয়া যায়গায় বোরোলিন লাগিয়ে দিচ্ছে - "জীবনের ছোটখাটো‌ ওঠাপড়া যাতে গায়ে না লাগে।" সেইরকমই তবে আর একটু বেশী। বলা যেতে পারে জীবনের মাঝারি ধরনের ওঠাপড়া যার স্মৃতি গায়ে বা মনে লেগে থাকে।


সাইকেল দিয়েই আখ্যান শুরু করা যেতে পারে। আমার বাবা ছিলেন শিক্ষক এবং ছাত্র জীবন থেকেই রাজনৈতিক কর্মী। রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে বার তিনেক জেলে খেটেছেন। একটানা প্রায় পঁচিশ বছরে চন্দননগর কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। ইস্কুল, পার্টি, সংগঠন‌ বা কর্পোরেশন সংক্রান্ত কাজে বাড়িতে থাকার সময় পেতেন খুব কমই। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চন্দননগর ও চুঁচুড়া শহর সংলগ্ন আশেপাশের জনপদ ও ছোট বড় গ্রামগুলিতে যাতায়াতের বিশ্বস্ত বাহন ছিল একটি ২৬ ইঞ্চি হারকিউলিস সাইকেল। বাবা‌ ছিলেন মাঝারি উচ্চতার মানুষ। পরতেন সাদা রঙের সুতির ধুতি ও পাঞ্জাবি। সাইকেলে উঠতেন সামনের রডের উপর দিয়ে পা ঘুরিয়ে। ধুতি পরার জন্যই হোক বা বাহনের অধিক উচ্চতার জন্যেই হোক শুরুর দিকে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই যেতো।। সিটের উপর বসে তারপর প্যাডেলে চাপ দিতে একটু পড়োপড়ো অবস্থায় এবং হালকা ব্রাউনিয়ান মোশানে কিছুদূর যাওয়ার পর বাবা এবং সাইকেল Stable হতো। পতনের নিত্য সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য পড়ে যাওয়ার ঘটনা একটিই। সেদিন বাজার করে, ধুতি সামলে সাইকেলের সিটে বসেছেন। এবার প্যাডেলে চাপ দেবেন, এরকম সময় ঘনশ্যামবাবু‌ বাবাকে দেখে উদ্বেল হয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরে কিছু বলতে যান। বাবাও তৎক্ষণাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে বাজারের ব্যাগ সমেত ভূলুন্ঠিত হন। সৌভাগ্যক্রমে বাবার সেরকম আঘাত লাগেনি। ঘনশ্যাম বাবুর ভাগ্য অবশ্য অতটা ভালো ছিল না। কারণ ধুলো ঝেড়ে উঠেই বাবা ওনাকে একটি সজোরে থাপ্পড় মারেন। উনি বাবার এই আকস্মিক পতনে এবং তদুপরি উত্থান পরবর্তী এই আক্রমণে হতভম্ব হয়ে বাবাকে কি বলতে চেয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ বিস্তৃত হয়ে গালে হাত বোলাতে বোলাতে বাড়ি চলে যান।


বাহন হিসেবে সাইকেলটি বাবার প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেও দাদার অভিজ্ঞতা বেদনাদায়ক। যে সময়ের কথা আমার বয়স তখন চার, দাদার চোদ্দ এবং সদ্য সাইকেল চালানো শিখেছে। সেদিন শহরের কেন্দ্রে হাসপাতাল মাঠের একদিকে বসে বাবা সম্ভবত শিক্ষক সংগঠন সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক মিটিং করছিলেন। আমি পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে দাদার কেরামতি দেখছিলাম। তখন সন্ধ্যা হব হব। আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। দাদা বাবার সাইকেলে চেপে সাঁই করে আবছা আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে, আবার সারা মাঠ ঘুরে মিনিট পাঁচেক বাদে বেল বাজাতে বাজাতে সামনে হাজির হচ্ছে। আমিও দাদার এই নতুন দক্ষতায় গর্বিত হয়ে “আবার আবার” করে দাবী জানাচ্ছিলাম । আচমকা দাদা একবার মিলিয়ে গিয়ে আর ফিরে এলো না। তার বদলে সুদূর অন্ধকার থেকে একটা কাতর চিৎকার ভেসে এলো


"বাবাগো, আমি পড়ে গেছি"।


বাবারা সবাই মিটিং থামিয়ে দাদাকে উদ্ধার করে ডাক্তারখানায় নিয়ে গেলেন। দাদা হাতে প্লাস্টার নিয়ে গৃহবন্দী একমাস। এর কিছুকাল পরেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। তবে এবার আর সাইকেল নয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা "বারো ভুতে" নাটকের রিহার্সাল দিতে গিয়ে সহঅভিনেতার পায়ে পা জড়িয়ে দাদার ভূমিশয্যা। অন্য হাতে প্লাস্টার জড়িয়ে দাদা আবার গৃহবন্দী।


উপুর্যপরি কয়েক মাসের ব্যবধানে দুই হাত ভাঙার মতো এই অনন্য কীর্তিটিও পরবর্তীকালে ছাপিয়ে যান আমার জামাইবাবু শরৎদা। আমার জেঠতুতো দিদির সঙ্গে শরৎদার বিয়ে হয় ১৯৮৪ তে। আমি তখন ক্লাস এইটে। বিয়ের পরে দিদিরা ভাড়া থাকতো চন্দননগরের চাঁদনী বেনেপুকুর অঞ্চলের একটি বাড়িতে। খুব সরু একটি গলি দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতে একটা ছোট্ট উঠোন। উঠোনের মাথায় ছিল টালির ছাত। উনিশশো পঁচাশির মার্চ মাসের এক ছুটির দুপুরে কেন শরৎদা এই ছাদে উঠেছিল ঠিক মনে নেই, তবে এটা মনে আছে সাত ফুট উচ্চতার ছাদের ধার থেকে শরৎদা লাফিয়ে নামে এবং দুটো গোড়ালিই ভেঙে যায়। এই উভয় সঙ্কটের ওপরেও তৃতীয় আর একটি সঙ্কট দেখা দেয়। কারণ শরৎদা এর কিছুদিন আগেই WBCS অফিসার নির্বাচনের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে আর ইন্টারভিউ এই পা ভাঙ্গার পরের দিন। সবাই বলতে থাকেন এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের এর আগের দিন টালির ছাদে উঠে লাফ মারা খুবই অনুচিত হয়েছে। শরৎদা দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেয় ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার। ভাঙ্গা পায়ের ব্যাথা আর ডাক্তারের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে, ওনার স্ত্রী ও শ্যালক অর্থাৎ আমার দিদি এবং দাদাকে ক্রাচ বানিয়ে, দুপায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়িয়ে, চন্দননগর থেকে কলকাতায় গিয়ে শরৎদা চাকরি সুনিশ্চিত করে। ইন্টারভিউয়াররাও এহেন ক্যান্ডিডেট পেয়ে নিশ্চয়ই চমৎকৃত হয়ে গেছিলেন। এর পর পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অব্দি প্লাস্টার করে মাস দুয়েক শয্যাশায়ী থাকার পর শরৎদা WBCS অফিসার হিসেবে কাজে যোগ দেয়। দু পায়ের অভূতপূর্ব যুগলবন্দী এবং তৎসহ ইন্টারভিউয়ের এই ত্র্যহস্পর্শ যোগটি আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের একটি চিরস্মরণীয় মাইলফলক‌।


তবে অধঃপতনের স্থানমাহাত্ম্যে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন আমার গৃহিনী। ১৯৯২ সালে সদ্য প্রেমে পড়ার পর আমি আর বৈশালী বি ই কলেজের হোস্টেল থেকে এসপ্লানেড চত্বরে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে আসতাম। তখনো সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ চালু হয়নি। কলেজ থেকে এসপ্ল্যানেড যাতায়াতের দুটি মাত্র উপায় ছিল। এক, বি গার্ডেন থেকে হাওড়া স্টেশন হয়ে এসপ্লানেড - এই রুটের মিনিবাস আর দুই, বিগার্ডেন - বাবুঘাট লঞ্চ সার্ভিস। সন্ধ্যে ছটার পর লঞ্চ বন্ধ হয়ে যেত। সুতরাং রাতের দিকে ফেরার একমাত্র উপায় ছিল ওই মিনি বাস। বাসের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। যথেষ্ট ভিড় হতো আর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তবে তার দেখা পাওয়া যেত। সেদিন সন্ধে সাতটা নাগাদ নিউ এম্পায়ারে সিনেমা দেখে বেরিয়ে হেঁটে মেট্রোর কাছাকাছি এসে দেখি বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। পা চালিয়ে বাস প্রায় ধরতে যাব এমন সময় একটা গেলো গেলো রব শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি প্রেমিকা ভুলুন্ঠিত। কিভাবে কি হলো ভালো করে বুঝতে পারার আগেই চটপট উঠে পড়ে বৈশালী জানায় যে সে অপেক্ষমাণ বাসটায় চাপবে না। আমি এই নির্দেশে ধন্ধে পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বাস আমাদের ফেলে চলে যায়। মুহূর্ত পরে আমার সম্বিত ফেরে এবং একটি ছোটো সংলাপপর্বের পরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়


আমি ।। কোথাও লেগেছে নাকি?

বৈশালী ।। না

আমি ।। হঠাৎ পড়ে গেলে কি করে? কেউ ধাক্কা দিয়েছিল নাকি?

বৈশালী ।। সেরকম কিছু নয়, আমি এমনিতেই একটু পড়ে যাই।

আমি ।। (ঢোক গিলে) কিন্তু বাসটায় কি সমস্যা ছিল, যেতে চাইলে না ?

বৈশালী ।। ওই বাসটার সবাই তো আমায় পড়ে যেতে দেখেছে, কি করে যাব!!


ন্যায্য কথা। পড়ে গিয়েও এই আত্মসচেতনতা বজায় রাখা যে সে ব্যাপার নয়। আমার মুগ্ধতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়‌। যদিও এর পরবর্তী প্রণয় পর্বে এবং ২৬ বছরের দাম্পত্য জীবনে এরকম স্বতঃস্ফূর্ত পতনের আর কোনো নিদর্শন পাইনি, তবে স্বতঃস্ফূর্ততায় না হলেও স্থানমাহাত্ম্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পেতে পারে পরবর্তী ঘটনাটি ।


ছিয়ানব্বই সালে কলেজের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ এর সৌজন্যে বৈশালী আর আমি একই কোম্পানিতে চাকরি পাই। সৌভাগ্যক্রমে দুজনেরই পোস্টিং হয় মুম্বাইতে। সেই আনন্দে চাকরি পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই আমরা বিয়ে করে ফেলি। বিয়ের পর ভাড়া থাকতাম বম্বের উত্তরে দহিসারে। তখন তথ্যপ্রযুক্তিতে Y2K এর বাজার। ভারতীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলির সেই সময় মুল ব্যবসা ছিল দেশী ইঞ্জিনীয়ারদের একটু শিখিয়ে পড়িয়ে বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে ভাড়া খাটানো। কাজেই চাকরিতে যোগ দেওয়ার এক থেকে দু বছরের মধ্যে বিদেশযাত্রা ছিল বাধ্যতামূলক। দু বছর চাকরি হয়ে যাবার পর আমাদের দুজনেরই গন্তব্য স্থির হয় পৃথিবীর দু প্রান্তে - আমি জাপান, বৈশালী আমেরিকা। ভিসার অ্যাপ্লিকেশান জমা দেয়ার পর বাড়িওয়ালাকে নোটিস দিয়ে দিই। বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার দিন চলে আসে কিন্তু ভিসা আসে না। আমি এক সহকর্মীর বদান্যতায় মাস খানেকের জন্য আশ্রয় পাই দুই কামরার একটি ফ্ল্যাটে আরও পাঁচজনের সঙ্গে শেয়ারে। বৈশালী কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে কলকাতা ট্রান্সফারের অনুমতি পায়। স্থির হয় ভিসা এলে কলকাতা থেকেই সোজা আমেরিকা চলে যাবে। এদিকে আমদের মুম্বাইয়ের একবছরের সংসারের তৈজসপত্র সহ আরও বিভিন্ন ছোটখাটো জিনিষের দুটো বড়সড়ো পুঁটুলি গৃহহারা হওয়ার পর থেকে আমরা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। বৈশালীকে এই দুটি পুঁটুলি সমেত প্লেনে উঠিয়ে দিয়ে আমি বিরহকাতর মনে ফিরে এলাম। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। সন্ধ্যেবেলা PCO থেকে বাড়িতে ফোন করে জানতে পারলাম বিপর্যয় ঘটে গেছে। মাঝ আকাশে প্লেন এয়ার পকেটে পড়েছিল। পাইলটের থেকে কোনও সতর্কবার্তা ছিল না। বৈশালী টয়লেটের দিকে যাওয়ার সময় আচমকা দুফুট উঁচুতে উঠে মেঝেতে পড়ে যায়। দাঁড়াতে গিয়ে বোঝে ডান পা মাটিতে ফেলা যাচ্ছে না। এরপর ভাঙা পা নিয়ে হুইলচেয়ারে করে প্লেন থেকে নেমে কীভাবে পুঁটুলি সমেত এয়ারপোর্ট থেকে কলকাতায় মামার বাড়িতে পৌঁছয় সে কাহিনী খুবই মর্মান্তিক। বৌয়ের এই দুরবস্থায় আমি কোনো কাজেই আসি না কারণ আমার ভিসাটি পরের সপ্তাহেই এসে যায়। আমি জাপান রওনা হই। দুমাস শয্যাশায়ী থাকার পর বৈশালীও আমেরিকা চলে যায়। সে যাত্রার কাহিনীও যথেষ্ট রোমহর্ষক কিন্তু এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, অন্য কোনো লেখায় তার বিবরণ দেওয়ার আশা রাখি।


চলন্ত প্লেনের ভিতর অনিচ্ছাকৃত ভাবে লাফিয়ে পা ভাঙার মতো চমকপ্রদ ঘটনা দিয়েই এ লেখায় দাঁড়ি টানা যেতে পারত। সেক্ষেত্রে আপনাদের মনে একটা খটকা রয়ে যেত যে এতক্ষণ যা বললাম সবই তো পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর গল্প, সুতরাং লেখার শিরোনামটি হওয়া উচিত ছিল "পতন ও উত্থান" । তার বদলে একে "উত্থান ও পতন" বলা কি ঠিক হচ্ছে ? এছাড়াও সন্দেহ হতে পারে যে, এদিকে বলছি ব্যক্তিগত উত্থান পতনের কাহিনী অথচ সব কটি গল্পেরই আমি পার্শ্ব চরিত্রে, নিজের পদস্খলনের ইতিহাস আমি কি নেহাত সাদামাটা বলেই চেপে যাচ্ছি?


এই দুইটি প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর আশা করি পেয়ে যাবেন এই শেষ গল্পে যার মুল প্রোটাগনিস্ট আমি স্বয়ং -


ঘটনাটি একেবারেই সাম্প্রতিক। কিছুকাল আগে ভিটামিন ডি এর স্বল্পতার কারণে গায়ের ব্যাথায় ভুগছিলাম। গত বছর থেকে ডাক্তারের পরামর্শ মতো ভোরবেলা বাড়ির সামনের পার্কে আধঘণ্টা হাঁটতে শুরু করি। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে প্রবল ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। জ্বর সেরে যাওয়ার পরেও অসম্ভব দূর্বলতার কারনে হাঁটতে যাওয়া হয়নি সপ্তাহ খানেক। ২১ সেপ্টেম্বর ভোর ছটায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে যাই। উদ্দেশ্য হিসু করেই হাঁটতে বেরিয়ে যাব। এর পরেই আমি কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখি আমি বাথরুমের মেঝেতে শুয়ে, চারপাশে রক্ত। আয়নায় নিজের মুখ দেখে আঁতকে উঠলাম। বাঁ চোখের ভুরুর ওপর থেকে কান পর্যন্ত চার ইঞ্চি লম্বা গভীর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। কোনও ক্রমে ক্ষতস্থান চেপে ধরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে গিন্নীকে ডাকলাম। এরপর হই হই কাণ্ড - হসপিটাল, ইমারজেন্সি, ছটা স্টিচ, ই সি জি, সি টি স্ক্যান, হলটার মনিটারিং এবং আরও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সাব্যস্ত হয় কলকব্জা মোটামুটি ঠিকই আছে। এখন ধাক্কা মোটামুটি সামলে উঠেছি, শুধু হ্যারি পটারের স্কারের মতো একটি আঁকাবাঁকা রেখা কপালে দৃশ্যমান। এরকম কেন ঘটলো জানতে চাওয়ায় ডাক্তার বাবু বললেন চিকিৎসাশাস্ত্রে ঘটনাটিকে বলে মিকটুরিনাল সিনকোপ - অর্থাৎ হিসু করতে গিয়ে বেহুঁশ। ভোরবেলা খুব দ্রুত বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গেলে ঘটনাটি ঘটতে পারে। এবং একবার যখন ঘটেছে আবার হওয়ার আশঙ্কা আছে যদি না সতর্ক হই। এখন তাই ভোরবেলা নিয়ম করে ঘুম থেকে উঠে পাঁচ মিনিট খাটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকছি, হঠাৎ করে উঠে পড়লে আবার উলটে পড়ার ঘোর সম্ভাবনা। আপনারাও একটু সাবধানে থাকবেন আর যদিও এই লেখাটি পড়ে সম্পূর্ণ ভুলে গেলেও বিশেষ ক্ষতি নেই, শিরোনামটি কিন্তু অবশ্যই স্মরণে রাখবেন -


কারণ, দ্রুত উত্থানের মধ্যেই আসন্ন পতনের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। অতএব সাধু সাবধান!


অক্টোবর, ২০২৩


Comments


Anchor 1
bottom of page