top of page

পাবলিক বাস

  • Writer: Subhadeep Ghoshal
    Subhadeep Ghoshal
  • Jul 27, 2021
  • 4 min read

Updated: May 6, 2022


ree

পাবলিক শব্দটি উৎপত্তিগতভাবে সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। ইংরাজি থেকে বাংলা ভাষায় এটির অনুপ্রবেশ আরও বহু ইংরাজি শব্দের মতোই। আর শুধু তো ইংরাজি নয়, আরবি, ফার্সি, তুর্কী, জাপানী, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসী – ইত্যাদি নানান বিদেশী ভাষার শব্দের অনুপ্রবেশে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে বহুকাল ধরে, উইকিপিডিয়ার বাংলা শব্দভাণ্ডারে ( উইকিপিডিয়া – বাংলা শব্দভাণ্ডার ) এরকম চমকপ্রদ উদাহরণ অনেক আছে, যদিও পাবলিক শব্দটি সেখানে নেই। আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধানে দেখলাম পাবলিক এর অর্থ বলা আছে জনসাধারণ। এখানেও শব্দটির অসাধারন হয়ে ওঠার কোনও ইঙ্গিত নেই।এতদসত্ত্বেও আমি মনে করি বাংলা ভাষায় অন্তত একটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বড় বিচিত্র। সেটি হল – পাবলিক বাস।


দেশে-বিদেশে পাবলিক শব্দটি যে ধরনের প্রতিষ্ঠান বা পরিষেবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় তা মূলত সরকার পরিচালিত – যেমন পাবলিক স্কুল, পাবলিক লাইব্রেরি, পাবলিক হেলথ ইত্যাদি। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। অনেক দেশেই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালায় বেসরকারি সংস্থা। আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম অবশ্যই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি যা শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত বেসরকারি সংস্থা, জনসাধারণ তার মালিকানার অংশীদার হতে পারেন শেয়ার কিনে। কিন্তু এই সব টুকিটাকি অসঙ্গতিকে ম্লান করে দিয়ে অনন্য এক নামভূমিকায় বাংলার শহর ও শহরতলীর সংখ্যাগুরু বাঙালীর জীবনকে গতিশীল রাখে এই পাবলিক বাস। আমরা জানি


সরকার পরিচালিত বাস - স্টেট বাস

বেসরকারি এক দরজার ছোটো বাস – মিনি বাস

মূলত সাদা কলারের অফিস যাত্রীদের জন্য নিবেদিত অপেক্ষাকৃত ভারী চেহারার বাস – চাটার্ড বাস,

আর দুই দরজাওয়ালা চকচকে টিনের শরীরের মাঝারী চেহারার সর্বত্রগামী যে বাস, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কেবল তারই নাম পাবলিক বাস


বেশ কিছুকাল আগে এই বাসগুলিতে বসতে হতো রাস্তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে। ঘনঘন গতির কমা বাড়ায় যাত্রীরা অনেকটা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই এক সমবেত নৃত্যে অংশ নিয়ে ফেলতেন।অনেকটা মেক্সিকান ওয়েভের মতো, তবে ওপরে নীচে নয় – ডাইনে বাঁয়ে। আমার আবার মোশান সিকনেস আছে। ঘনঘন গতির তারতম্যে অনেক সময়ই গা গুলিয়ে ওঠে, ছোটবেলায় ব্যাপারটা তীব্রতর ছিল।আর এই পাবলিক বাস আমাকে খুবই চাপে ফেলত। আমরা থাকতাম চন্দননগরের বাগবাজার এলাকায়। পাশের শহর চুঁচুড়া। সেখানে গঙ্গার ধারে আমার সেজো মাসীর বাড়ী। আর আমার মামারবাড়ী ছিল এই চন্দননগর, চুঁচুড়ার মধ্যবর্তী বুড়োশিবতলায়। অন্তত মাসে একবার আমি মায়ের সঙ্গে দুপুরবেলা মামারবাড়ী যেতাম, সেখানে ঘণ্টা দুতিন কাটিয়ে শেষ বিকেলে সেজো মাসীর বাড়ী। যাওয়ার সময় বিশেষ সমস্যা ছিল না। বুড়োশিবতলার মামারবাড়ী বাস রাস্তা থেকে অনেকটাই দূরে। তাই রিক্সা করে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেখান থেকে মাসীর বাড়ীও আবার রিক্সাতেই। যথেষ্ট উৎসাহর সঙ্গেই যেতাম, বাড়ীটির অদ্ভুত নকশা আমাকে টানত। ঘর, উঠোন, পাঁচিলের আদল এক এক অংশে এক এক রকম, এমনকি এক এক উচ্চতায়। মনে হোতো অনেকগুলো বাড়ী যেন এক সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আকর্ষণের কারণ ছিল মেসোমশাইয়ের নানান আকৃতির তামাক খাওয়ার পাইপ এবং সর্বোপরি হনিডু নামের সবুজ রঙের একটি মিষ্টি যা চুঁচুড়ার একটি বিশেষ দোকানেই পাওয়া যেতো। পরে বুঝেছি ওটার নাম আসলে হানি ডিউ (Honey Dew), অপভ্রংশ হয়ে হনিডু নাম হয়েছে, তবে মধুর রঙ কেন সবুজ এ সন্দেহ রয়েই গেছে।


যাই হোক আসল সমস্যাটা হত বাড়ী ফেরার সময়। ২ নম্বর পাবলিক বাস চুঁচুড়া ঘড়ির মোড় থেকে ছাড়ত আর যেতো বাগবাজারে একদম বাড়ীর সামনে দিয়ে। প্রতিবার আমি আর মা সেই বাসে যাত্রা শুরু করতাম। চুঁচুড়ার শেষ সীমানায় খাদিনা মোড় বাস স্টপ। সেই অবধি কোনক্রমে টেনে দিতাম, তারপর তালডাঙা, মুন্সিপুকুর, বক্সিগলি, পঞ্চাননতলা, বোড়ো কালীতলা, সরষেপাড়া – এর মধ্যবর্তী যে কোনো স্টপে নেমে আমি বমি করে ফ্রেশ হয়ে নিতাম। তারপর সেখান থেকে রিক্সা করে বাড়ী । কদাচিৎ লক্ষীগঞ্জ বাজার, হাসপাতাল মোড় অতিক্রম করে বাগবাজারের বাসস্টপে যাত্রা সম্পূর্ণ করতে পেরেছি – নেহাতই হাতে গোনা সে সাফল্য, প্রায় পাঁচ বছর ব্যাপী এই যাত্রা ইতিহাসে সাকুল্যে দু তিন বার হবে। মিনিবাসে চাপলে কিন্তু আমার এরকম সমস্যা হোতো না, সম্ভবত সীটের অবস্থান গতির অভিমুখে হওয়ার জন্যেই। কলেজজীবনে, চাকুরী জীবনের প্রথম ভাগে মিনি বাসে বা স্টেট বাসে যাত্রা করেছি অসংখ্যবার, এমনকি প্রেমপর্বের বহু আবেগঘন আলাপাচারিতার সাক্ষী বিগার্ডেন – এসপ্ল্যানেড রুটের মিনিবাস। কিন্তু পাবলিক বাস সম্পর্কে শৈশবের ভীতি আর কাটাতে পারিনি। নেহাত আতান্তরে না পড়লে তাই পাবলিক বাসে চাপিনি, সীটের বিন্যাস বদলে যাওয়ার পরেও।


১৯৯৯ সালে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে আসার পর সল্টলেক অঞ্চলে একটি বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম। নিজের বাড়ী চন্দননগর আর শ্বশুরবাড়ি বর্ধমান যাওয়া আসা করতে হতো হামেশাই। সল্টলেক থেকে বাসে হাওড়া স্টেশান, সেখান থেকে ট্রেন। হাওড়া সল্টলেক রুটের একটি জনপ্রিয় বাস ছিল ২১৫A, এখনও সেটি স্বমহিমায় বিরাজমান। আমি দু একবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কখনো শম্বুকগতি, কখনো ফরমুলা ওয়ানগতির টানা পোড়েনে আমার লাল সুতো, নীল সুতো বেরিয়ে যাবার অবস্থা হতো। আমার শ্বশুরমশাইয়ের কিন্তু এই ২১৫A বাসটি ছিল অসম্ভব প্রিয়। প্রতিবার যাত্রা করার পর উনি অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে জানাতেন – “ফার্স্টক্লাস এলাম” আর আমি হতভম্ব হয়ে যেতাম। দু বছর সল্টলেকে কাটিয়ে ছিলাম – শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোনও ঋতুতেই ২১৫A’ র এই প্রথম শ্রেণীর পরিষেবায় আমি কোনও খামতি দেখিনি বরং মনে হত উৎকর্ষতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।


২০০৩ সালে প্রথম গাড়ী কেনার এবং পরবর্তী কালে বেশ কিছুটা সময় বিদেশ বাসের ফলস্বরূপ বাসে চাপা খুবই কমে যায়। অধুনা অ্যাপ ক্যাবের যুগে এসে পাবলিক, মিনি বা স্টেট কোনও বাসেই চড়িনি বহুকাল। প্রাইভেট গাড়ীর আপাত মসৃণ যাত্রাপথে উচ্ছৃঙ্খল পাবলিক বাস রাস্তা জুড়ে যাওয়া একটি আপদ মাত্র, তার ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, যাত্রীরা সবাই আমার কাছে ভিনগ্রহের মানুষ হয়ে গেছে অনেকদিন। আচমকা তাই পাবলিক বাস নিয়ে আমার এই অতি উৎসাহে চেনা জানা অনেকেরই ভ্রুকুঞ্চন হতে পারে। আসলে সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর পাবলিক বাস নিয়ে একটি চমৎকার লেখা পড়ার সুযোগ হয়। লেখাটির শিরোনাম –

“তোমার বাস কোথা যে পথিক”

এমনিতে সংবাদপত্রে পাবলিক বাসের উল্লেখ অপ্রতুল নয়। তবে তা “দুইটি বাসের রেষারেষিতে পথচারীর মৃত্যু” বা “নির্বাচন জনিত কারণে বাসের অভাবে যাত্রীদের ভোগান্তি” ইত্যাদি হতাশাব্যাঞ্জক খবরেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর তথ্যপ্রযুক্তির বরপ্রাপ্ত সামাজিক মাধ্যমগুলিতে বিভিন্ন “মন ছুঁয়ে যাওয়া”, “ফরওয়ার্ড” কণ্টকিত এবং “সংগৃহীত” লেখনীর ভিড়েও এরকম নৈর্ব্যক্তিক অথচ মরমী লেখা চট করে চোখে পড়ে না। তাই এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি। বাস, কন্ডাক্টর, ড্রাইভার, যাত্রী সবাই এ লেখায় কথা বলে – তাদের দৈনন্দিনের কষ্ট, হতাশা, উত্তেজনা, কৌতুক আমাকে স্পর্শ করে। লেখাটি একদিকে আমার স্মৃতির মণিকোঠায় পুরোনো এ্যালবামের পাতা ওলটায়, অন্যদিকে আমার অগণিত সহ নাগরিকের মাথার ঘাম পায় ফেলা বর্তমানের সহযাত্রী করে নেয়। আর এই কল্পযাত্রায় মোশান সিকনেসের ভয় নেই, তাই মাঝরাস্তায় নেমে পড়তে হয় না। শুধু যাত্রা শেষে আপাত সচ্ছ্বলতায় লালিত নব্য মধ্যবিত্তের কূপমণ্ডূক মনে কোথাও একটা গ্লানির রেশ হয়তো থেকে যায়।


জুন, ২০২১


ঋণস্বীকার

তোমার বাস কোথা যে পথিক – অম্লানকুসুম চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ মে ২০২১


Comments


Anchor 1
bottom of page