top of page

এক, দুই, তিন …

  • Writer: Subhadeep Ghoshal
    Subhadeep Ghoshal
  • May 31, 2020
  • 5 min read

Updated: May 6, 2022


ree

আপনারা অনেকেই জানেন নিশ্চয়ই, কারণ দেখছি ইদানিং, সকলেই প্রায় সবকিছু জানেন, সকলেই গুরু। তবু হতেও তো পারে, দৈবাৎ কথাটা আপনার আসেনি গোচরে। যদিও সম্ভাবনা অল্প, তাও নিতান্ত সাধারণ এই গল্প, এই দিয়েই করি শুরু -

আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিমে খোইখোইদের বাস। গণিতের সহজ নিয়মে ওদের আপন ভাষায়, একের পরে আসে দুই, দুইয়ের পরে তিন, ব্যাস! ওখানেই ওরা থামে। খোইখোইদের গ্রামে গোনাগুনতির দায়, তিনেই মিটে যায়। আশ্চর্যের এই ঝুটঝামেলাও নেই, এই গণিতেই দিব্যি চলে খোইখোইদের দিন। একের পরে দুই আর দুইয়ের পরে তিন, তিনের পরে যা কিছু সব নিছক সংখ্যাহীন। অথচ আমরা শিখেছি গুনতে অযুত, লক্ষ, নিযুত, কোটি, দশের মাথায় সংখ্যা চড়িয়ে যেতে পারি দেশকাল পেরিয়ে অনন্ত অসীমে, এত সংখ্যা জেনে কি যে হয় ছাই! কিছু সংখ্যা বাড়লে যদিও তেমন দুঃখ নাই। যেমন ধরুন বার্ষিক প্যাকেজ বা সুপার বিল্ট এরিয়া। কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়ে যদি যায় আয় করের খাঁই আর লোনের ইএমআই, তখন হৃদয়ে থাকে বিষাদে ভরিয়া। অথবা ধরুন আধুনিক মতে বয়স আমার উনপন্চাশ হবে পুরনো হিসেবে তো দুই কুড়ি নয় দিব্যি চলে যাবে। তবে উনপন্চাশই বলুন বা দুই কুড়ি নয় সন্দেহ একটা হয়, আমাকে বানানোর তরে এত আয়োজনের প্রয়োজন ছিল কি, যুগ-যুগান্ত ধরে ? সেতো কোন কম সংখ্যার ব্যাপার নয় প্রায় চোদ্দশ কোটি বছর তো হবে - দেখুন দেখি কান্ড, কোথ্থাও কিচ্ছু নেই, শূন্য থেকে বিস্ফোরণে জন্মালো ব্রহ্মাণ্ড। শক্তির কম্পন চলল দেশকাল জুড়ে এদিক-সেদিক ঘুরে আদিম কনারা সব জড়ো হলো তারার শরীরে। আবার পেরিয়ে কল্প, ভীষণ আকর্ষণে ভেঙে গেল নক্ষত্র দেহ, সে দেহের ধূলিকণা ঘুরে ছায়াপথ সন্ধান করে, মাঝারি হলুদ এক সূর্যের কাছে, বানালো নীলাভ এই গ্রহ। শুরুর দিকটা স্বস্তিতে কাটেনি। গ্রহাণুপুঞ্জের অবিরাম আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে একসময় আকাশে উঠলো চাঁদ - তখন সাগর মাটি, আর আগুন হাওয়া, পেল জিয়ন কাঠি, দিল প্রাণের ছোঁয়া। সেই জীবনস্রোতে ভেসে যেতে যেতে নীল সাগর তলে, মরু অরণ্যেতে, চঞ্চল প্রকৃতির কোন সৃষ্টি নেশায় কত প্রাণের রূপে, কত প্রাণের দেহে, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম - ঠিক সময় চিনে, জেগে উঠবো বলে সেই একটি দিনে? তখন আমার সাত মাস বয়স, রিক্সা করে যাচ্ছিলাম মাসির বাড়ি, মায়ের কোলে চেপে। দাদা ছিল পাশে, হঠাৎ কিসের ধাক্কায় রিক্সা গেল উল্টে, মা আর দাদা রিক্সার নিচে আর আমি সটান খোলা রাস্তায়, চিৎপটাং। যেকোনো মুহূর্তে গাড়ি এসে, আমার ভব লীলা ওখানেই শেষ করে দিতে পারতো, দৈবাৎ বেঁচে চাই। তারপর থেকে আমার চেহারায় বাঁকাচোরা ভাবটা একটু প্রকট। সন্দেহ থাকলে, প্রোফাইল পিকচার জুম করে দেখতে পারেন। কানের পাশ দিয়ে মৃত্যু ওই একবারই চলে গিয়েছিল, তারপর থেকে মোটামুটি শান্তিতেই কেটেছে। নেহাতই কপাল জোরে বলতে গেলে কেননা, পাড়ার মাঠের পাঁচিল ভেঙ্গে মারা যাওয়া সমবয়সী শিশু। ক্লাস ওয়ানে, হঠাৎ অসুখে, অ্যাবসেন্ট হয়ে যাওয়া রোল নাম্বার টোয়েন্টি থ্রি, রেল লাইনের ধারে খুন হয়ে যাওয়া অনুজ কিশোর, কোন অজ্ঞাত ব্যথায়, আত্মহত্যায় শেষ হয়ে যাওয়া প্রিয় সুহৃদ, মোটর এক্সিডেন্টে মৃত, আট নম্বর হোস্টেলের সহ আবাসিক, হূদরোগে প্রয়াত প্রাক্তন সহকর্মী, ফুসফুসের ক্যান্সারে চির বিদায় জানানো সহপাঠী, রাষ্ট্রের এনকাউন্টারে লাশ হয়ে যাওয়া যুবক, সন্ত্রাসবাদীর বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া অফিস যাত্রী, সমুদ্রের বুকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া প্লেনের প্যাসেঞ্জার, রেলের ওভারব্রিজে পিষে যাওয়া বেনামি দেহ - অথবা কোভিড নাইনটিনে ধাপার শ্মশানে অচ্ছুৎ ছাই হয়ে যাওয়া সহনাগরিক - এর যেকোনো একটাই আমি হতে পারতাম। মৃত্যুর অসংখ্য সম্ভাবনা পেরিয়ে, আশ্চর্যজনকভাবে, এখনও যে বেঁচে আছি, সত্যি বলতে কি এই উনপন্চাশ বছরে, সেরকম কোনো কাজেই লাগতে পারিনি। নেহাতই মাঝারি মানুষ। কোনো মুমূর্ষুকে পারিনি বাঁচাতে, কোন শোষিতকে পারি নি জাগাতে, কিছুই পারিনি বানাতে। তবে হ্যাঁ, প্রেম করেছি চুটিয়ে। তখন আমি একুশ বছর পেরিয়ে, মেয়েটি ছিল উনিশের ছোঁয়ায়, সেই নরম চোখের চাওয়ায়, কপট রাগের ভ্রূকুঞ্চনে, জ্যোৎস্নার আলো ঝরা হাসিতে, বানভাসি চুম্বনের টানে, সেই যে তলিয়ে গেলাম - এতগুলো বছর ধরে, দুঃখগুলোকে ঢেকে রাখলাম আদরে আদরে এই একটি কারণে, পাগলী তোমারই জন্যে, কোনো ব্যাথা ভরা বিরহের কবিতা আমার আজও লেখা হয়ে উঠলো না। এই আমার মোটামুটি জীবনচরিত। বলতে পারেন ধান ভানতে শিবের গীত। শুরু করেছিলাম সংখ্যার কমবেশি নিয়ে, কথায় কথায়, কোথাকার জল কোথায় গড়ালো। অপরাধ নেবেন না, আসলে সংখ্যা ব্যাপারটাই এরকম ঘোরালো। যেমন ধরুন কয়েক বছর আগে, এক বিখ্যাত বিশেষজ্ঞের পরিশ্রমী গবেষণায়, অবশেষে জানা যায়, দারিদ্র্যসীমা পেরোতে পারেন দৈনিক মাত্র বত্রিশ টাকায়। যদিও মন্দার বাজার, তাই গবেষণা চালাতে থাকা-খাওয়া ইত্যাদিতে ওনার একারই খরচ পেরোয়, দৈনিক বত্রিশ হাজার। আবার ধরুন আক্রান্তের সংখ্যা। ইদানিং কয়েক মাস হল ভাইরাল ভয়ে, টিভিতে, কম্পিউটারে, ফোনে, আমাদের ত্রস্ত চোখ কান, সারাদিন দেখে শোনে - কোথায় আক্রান্তের সংখ্যা কতটা ছাড়ালো। অথচ আক্রান্তের সংখ্যা তো কম বেশি হয়েই থাকে, আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যাও। মুম্বাইয়ের রাস্তায়, দিল্লির বাজারে, গুজরাতের গলিতে, কাশ্মীরের পাহাড়ে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে, বাটাক্লান থিয়েটারে, মাদ্রিদের ট্রেনে, তিয়েন আন মেনে, লন্ডন ট্রান্সপোর্টে, নিসের সমুদ্রতটে, মনিপুর, আসাম, বস্তার, নন্দীগ্রাম, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরাক, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, জাফনা, কলম্বো, মিউনিখ, ফ্লোরিডা, সোমালিয়া, রোয়ান্ডা, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, বার্মা, বসনিয়া - কখনো রাষ্ট্রের আক্রমণে গনহত্যায়, সাজানো এনকাউন্টারে, কখনো সন্ত্রাসবাদীর গুলিতে, সুইসাইড বম্বারে, আক্রান্তের সংখ্যা তো প্রতিনিয়তই বাড়ছিল, আমরা আক্রমণকারী হলে সাময়িক উল্লসিত হয়েছি, আমরা আক্রান্তের দিকে থাকলে কিছুদিন বিষন্ন থেকেছি, তারপর আবার ফিরে গেছি যে যার নিজস্ব ছকে। তাহলে ইদানিং কোন সে কারণে, ত্রস্ত নজর রাখি সংখ্যার বিবর্তনে? সার্জিক্যাল স্ট্রাইক মুছে ফেলার মত কোন আক্রমণকারী নেই বলে ? কেন যেন মনে হয় এই প্রথম আমরা আক্রান্তকে ভয় পাচ্ছি আশ্চর্য এই অতিমারী যারা আজ অসুস্থ বা মৃত যারা আজ আক্রান্ত তারাই আক্রমণকারী। আশ্চর্য অবশ্যই, যদিও যুধিষ্ঠির শুনলে বলতেন, তেমন কিছু নয়। "আশ্চর্য কি?" যক্ষ প্রশ্ন করেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে, বকরুপী যক্ষকে অবহেলা করে চার ভাই তখন স্থির। "প্রতিদিন জীবের মৃত্যু হচ্ছে, তথাপি যে লোকে চিরদিন বাঁচতে চায়, তাই আশ্চর্য" - বলেছিলেন যুধিষ্ঠির। আমিও কি তাই চাই ? গুরুজনেরা একে একে প্রায় সকলেই বিদায় নিয়েছেন। মধ্যবয়স পেরিয়ে, প্রৌঢ়ত্বের দরজায় কড়া নাড়ছি, কলকব্জারা দুর্বল হচ্ছে, কোষেদের মৃত্যু হার বাড়ছে। তবু হয়তো চিরদিন বাঁচার ইচ্ছা অবচেতনে খেলা করে, তাই মৃত্যুর ভাবনায় ত্রস্ত হই। যদিও জানি, আজ হোক বা কাল, বছর দুই,চার,পাঁচ,দশ বা বড়জোর তিরিশ, ভাইরাসে হোক বা সন্ত্রাসে, হঠাৎ এক মুহূর্তে বা বহুকাল ভুগে, সর্বগ্রাসী ক্যান্সারে বা হূদযন্ত্রের রোগে, আমার ভবের খেলা ফুরোবে অবশ্যই। অনন্ত সময়ের মধ্যে আটপৌরে এই ক্ষুদ্র জীবন, ফুৎকারে মিলিয়ে যাবে। দেহকণা যত ছড়িয়ে যাবে আকাশে, মাটিতে, জলে, আগুনে - কখনো প্রাণের দেহে কখনো অপ্রাণে। তারপর, সাতশো কোটি বছরের পরে সূর্য গ্রাস করে নেবে পৃথিবীর শরীর, তারায় জন্ম আমার মিশে যাবো তারার ভিতরে। সে অনেক যুগ পরের কথা, আপাতত এখানেই ইতি। শেষ করবার আগে একবার গোড়ায় ফিরি - খতিয়ে দেখলে, এক দুই তিনের থেকে সংখ্যা কিছু বেশি জানা হয়তো জরুরী। তার থেকেও যেটা জানানো দরকার, যদিও আপনারা সবই জানেন, এটাও গোচরে থাকা অসম্ভব নয় অনন্ত অসীমেরও রকমফের হয়। বুঝুন তবে ব্যাপার! গণিতবিদেরা হিসেব কষে, বলতে পারেন নাকি কোন অনন্ত ক্ষুদ্রতর, কোনটি বৃহদাকার। আমি তখন ভাবি, আমার তুচ্ছ বেঁচে থাকাও তবে রাখতে পারে অনন্তেরই দাবি। প্রিয় সব স্বজন সুজনেরা, ভুলে যাওয়া মনে রাখা অগুনতি সেই ছোট্ট মুহূর্তেরা, মহাকালের খাতায় রাখছে লিখে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনটিকে। তাই আজ হোক বা কাল, মৃত্যু যদি আসে, আমিও অনায়াসে - যেতেই পারি এক মহাকাশ ভালোবাসা রেখে, এক দুই তিন পেরিয়ে, অনন্তেরই দিকে।

মে, ২০২০


সাহায্যসূত্র ও ঋণস্বীকারঃ

  1. One Two Three… Infinity: Facts and Speculations of Science, a book by George Gamow

  2. The Fault in Our Stars, a 2014 American romantic drama film directed by Josh Boone, based on the 2012 novel of the same name by John Green

  3. Cosmos: A Personal Voyage, a thirteen-part television series written by Carl Sagan, Ann Druyan, and Steven Soter, with Sagan as presenter

  4. Short History of Nearly Everything a popular science book by American-British author Bill Bryson

  5. History of Our World in 18 Minutes, Ted Talk by David Christian

  6. The Third Chimpanzee: The Evolution and Future of the Human Animal, a book by Jared Diamond

  7. অরিন্দম চক্রবর্তীর সাক্ষাতকার , বইয়ের দেশ

  8. ছেলেদের মহাভারত, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

  9. আমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  10. আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে, জয় গোস্বামী

  11. পাগলী তোমার সঙ্গে, জয় গোস্বামী

  12. অরুণ মিত্র, কবীর সুমন

  13. আজ আছি কাল নেই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়

  14. অসমাপ্ত কবিতা, নির্মলেন্দু গুন

Image Credit – From the Book One Two Three… Infinity: Facts and Speculations of Science, illustration by author George Gamow showing African Native and Prof G Cantor comparing the numbers beyond their counting abilities

Comments


Anchor 1
bottom of page