top of page

উকুচি, বুকুচি, পকালি

  • Writer: Subhadeep Ghoshal
    Subhadeep Ghoshal
  • Jul 21
  • 11 min read

নামমাত্র - প্রথম পর্ব


“ … আমি বললাম, 'তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিশুদ্ধ সবাই হিজিবিজ্‌বিজ্‌। '  সে আবার খানিক ভেবে বলল, 'তা তো নয়, আমার মামার নাম তকাই । আমার মামার নাম তকাই, আমার খুড়োর নাম তকাই, আমার মেশোর নাম তকাই, আমার শ্বশুরের নাম তকাই ……” ' 

হ য ব র ল, সুকুমার রায়


ree

শেক্সপিয়ার বলেছেন " নামে কিবা আসে যায়"।  সত্যই তো, আমার নাম যদি  শুভদীপ না হয়ে অমলকান্তি হতো তাহলেও তো শেষ অবধি আমি কিম্ভূতই হতাম, রোদ্দুর হতে চাওয়ার মতো কল্‌জের জোর আমার থাকতো বলে মনে হয় না।  তেমনই  আমার স্ত্রীর নাম  যদি বৈশালী না হয়ে নিস্তারিণী হতো, সেক্ষেত্রেও আমার সমস্ত জাগতিক ভুলত্রুটির প্রতি তাঁর যে কড়া নজর, তা থেকে নিস্তার পেতাম না নিশ্চয়ই। আবার ধরুন আমার ছেলের নাম যদি অনুরাগ না রেখে বীতস্পৃহ রাখতাম, অমনি সে ভোগবাদী দুনিয়ার অমোঘ সব আকর্ষণ অর্থাৎ আইফোন, ইন্সটাগ্রাম, নেটফ্লিক্স, কে এফ সি ইত্যাদির প্রতি বীতরাগ হয়ে পড়তো - এমন ভাবাটাও নিশ্চয়ই ভুল হবে।


কিন্তু তাই বলে কি উদোর নাম আমরা বুধোর ঘাড়ে চাপাতে পারি? কিংবা হযবরল 'র সেই সদাহাস্যময় প্রাণীটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা যদি গুষ্টিশুদ্ধ সকলের নাম তকাই, হিজিবিজ্‌বিজ্‌ বা বিস্কুট রাখি তা হলেও তো ঘোর বিপদ। সুতরাং বাবা মাকে অনেক চিন্তা ভাবনা করেই  ছেলেমেয়ের নাম রাখতে হয়। অনেকক্ষেত্রে এ ব্যাপারে মতানৈক্য থেকে ছোটোখাটো মনোমালিন্য বা কিছুক্ষেত্রে গুরুতর গৃহবিবাদ অবধি লেগে যায়।  অধুনা জনপ্রিয় পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজের একটি পর্বে (Season 1, Episod 7) এইরকম একটি নামকরণ সংক্রান্ত দাম্পত্য কলহের মধ্যস্থতা করতে গিয়ে নায়ক পঞ্চায়েত অফিসার অভিষেক ত্রিপাঠিকে যথেষ্ট বিপাকে পড়তে দেখা যায়। বাবার ইচ্ছা ছেলের নাম হবে আরভ, মায়ের পছন্দ আত্মারাম - সেই নিয়ে তুলকালাম। শেষ অবধি পঞ্চায়েত অফিসারের সমাধান সূত্র মেনে নিয়ে তর্জনী আর মধ্যমাকে যথাক্রমে আরভ আর আত্মারাম বানিয়ে দশ দিনের শিশুর সামনে ধরা হলে সে চেপে ধরে তর্জনী। ছেলের সিদ্ধান্ত মা মেনে নেন। সংসারে শান্তি ফিরে আসে। 

 

বাবা মায়ের নিজস্ব পছন্দের পাশাপাশি দেশ, কাল, সংস্কৃতি, ভাষা এমনকি আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিও এই নামকরণকে প্রভাবিত করতে পারে। গত জানুয়ারী মাসের (২০২৪) ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনে সম্পাদক জিনয় জোস এরকমই একটি প্রবণতার উল্লেখ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের প্রথমার্ধ অবধি কেরালায় সাজি, বিজু, বাইজু সিজু, মায়া, প্রিয়া, মিনি, সিনি এই ধরনের নামকরণ খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং এটা হয়েছিল জাতিধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সবার মধ্যেই। সম্পূর্ণ নামে শুধুই আদ্যক্ষর ব্যবহার করার প্রথা ছিল, যেমন কে. এন. সাজি, টি. টি. বাইজু, সি. কে. জয়া, প্রিয়া পি. এস. - নামের মধ্যে দিয়ে জাতধর্ম নিরপেক্ষ পরিচয় গড়ে তোলার প্রবণতা তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দেখা দিয়েছিল কেরালায়। রামজন্মভুমি আন্দোলন এবং অর্থনীতির উদারীকরণের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে এই প্রবণতা আবার বদলে যেতে থাকে - সাজি, বাইজু, বিজু, প্রিয়ার জায়গায় ফিরে আসে শিবশঙ্কর, বেনেডিক্ট, আবদুল রশিদ, আনা মারিয়াম ম্যাথু - নিজেদের জাত ও ধর্মকে ব্যাক্তিনামের মধ্য দিয়ে ঘোষণা করবার পুরনো প্রথা আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কেরালা জুড়ে। 


বাংলায় একসময় হিন্দু পুত্রসন্তানের দীর্ঘ নাম রাখার রীতি ছিল, অনেকসময় পাঁচ বা তারও বেশী অক্ষরবিশিষ্ট - যেমন রামমোহন, মদনমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, নরেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, কানাইলাল। ইদানীং এই প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে, অভিধান খুলে বাবা মায়ের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে তিন বা বড়জোর চার অক্ষরের নাম বেছে নেওয়ারই চল এখন। দীর্ঘনাম একদম যে দেখা যায় তা নয় তবে তা ব্যতিক্রম - যেমন অকালপ্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী কালিকাপ্রসাদ। ছেলেবেলায় দুজন খেলার সাথীর এরকম ব্যতিক্রমী দীর্ঘ নাম দিজেন্দ্রনাথ আর দীপনারায়ণ - যথেষ্ট সম্ভ্রম জাগাত। আমার পিতামহ ধীরেন্দ্রনাথ জীবন সায়াহ্নে অধিক পুণ্যলাভের আশায় তাঁর কনিষ্ঠ দুই সন্তান, আমার দুই কাকার নাম রেখেছিলেন দুর্গানারায়ণ ও কালীকৃষ্ণ। একজনকে ডাকলেই শাক্ত ও বৈষ্ণব দুই মতেই পুণ্যলাভ নিশ্চিত। মাতামহ প্রভাতকুমার ছিলেন প্রগতিশীল মানুষ। প্রথম চারটি সন্তান মেয়ে। নাম রেখেছিলেন - পুতুল, উৎসা, মঞ্জুলা এবং আমার মা কুহু। এই অত্যাধুনিক কুহু নামটি নিয়ে মাকে মাঝে মাঝে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। কলেজে ভর্তির সময় প্রিন্সিপাল নাম শুনে খুবই বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন - "এ আবার কি রকম নাম -  হাহা, হিহি, হুহু,  কুহু ?" সম্ভবত উনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে কুহুকে যদি নাম হিসেবে মেনে নিতে হয় সেক্ষেত্রে হাহা, হিহি, হুহু নামকরণই বা আটকাবে কে? তবে মায়ের নামকরণের পর দাদুও বোধহয় সতর্ক হয়েছিলেন, কারণ এর পরের তিন পুত্র  সন্তানের নাম রাখেন শ্যামল, অমল ও অলক - তিন অক্ষরবিশিষ্ট সেকুলার নাম যা সেই সময় এবং পরবর্তী বাঙালী নামের মূলধারা হয়ে ওঠে। বাঙালী হিন্দু তার পদবীতে জাতপাতের পরিচয়টি বিসর্জন দিতে না পারলেও নামে ধর্মনিরপেক্ষ আত্মপরিচয়কেই প্রাধান্য দেয়। অধুনা দেশজুড়ে হিন্দুজাতীয়তাবাদের যে হাওয়া প্রবল ভাবে বইছে তাতে হিন্দু বাঙালী তার ধর্মপরিচয় নবউদ্যমে প্রতিষ্ঠার নেশায় দলে দলে রামমন্দির দর্শনে অযোধ্যায় বা লক্ষকণ্ঠে গীতা পাঠ করতে ব্রিগেডে ছুটলেও, ছেলের নাম দুর্গানারায়ণ বা কালীকৃষ্ণ রাখতে খুব একটা উৎসাহী হবেন কিনা সন্দেহ।    

           

ধর্মভীরু ঠাকুরদা বা প্রগতিশীল দাদু কাউকেই আমি অবশ্য সচক্ষে দেখিনি। দুজনেই আমার জন্মের অনেক আগেই গত হন। ঠাকুমাও তাই। তবে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমার দাপুটে দিদিমাকে। আধুনিকতা আর সাম্যবাদের আদর্শে প্রভাবিত আমার মামারবাড়িতে পূজোআচ্চার পাট ছিল না। দাদু মারা যাবার পর দিদিমাও তাই সাদা থান পরা ছাড়া আর কোনও নিয়মকানুন মানতেন না। জাগতিক সমস্ত ব্যাপারে ছিল অসম্ভব কৌতূহল। মাঝে মধ্যেই সঙ্গী জুটিয়ে নানারকম দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটাতেন। সত্তরের দশকের শেষভাগে আমার বয়স যখন পাঁচ কি ছয়, চন্দননগরে অনুষ্ঠিত হয় কিশোরকুমারের সারা রাত্রি ব্যাপী গানের অনুষ্ঠান, কিশোরকুমার নাইট্‌স। কিশোরকুমারের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। মফস্বল শহরে এরকম একটি সর্বভারতীয় ধামাকা খুবই আড়োলনের সৃষ্টি করে। দিদিমা হিন্দি সিনেমা বা গানের বিশেষ ভক্ত না হলেও এই কিশোরকুমার নাইট্‌স দেখবেন মনস্থ করেন।  ছেলেমেয়ে বা নাতিনাতনিদের দিক থেকে বিশেষ সাড়া না পেয়ে শেষে আমার বড় জেঠাইমা এবং জেঠতুতো দিদিকে রাজী করান সঙ্গ দিতে। দিদি তখন ক্লাস এইট বা নাইন, জেঠাইমা পঞ্চাশের কোঠায়, দিদিমা সম্ভবত পঁয়ষট্টি। স্বভাবে দিদিমার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন জেঠাইমা। দিদির শৈশবেই আমার বড়জেঠা মারা যাওয়ার পর যথেষ্ট নিষ্ঠা সহকারেই বাঙালি হিন্দু বিধবার নিয়মনিষেধ মানতেন। বাড়ি থেকে বেরোতেন খুব কম, বেরোলেও ভিড়ভাট্টা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন । তবে অভিনেত্রী ছায়া দেবী সম্পর্কে মামীমা হওয়ায় চিত্রজগতের তারকাদের প্রতি একটা গর্বমিশ্রিত আত্মীয়তার টান প্রকাশ পেত।  সম্ভবতঃ সেই কারণেই জেঠাইমা এইরকম স্বভাববিরোধী একটি  অভিযানে অংশ নিতে রাজী হন।  বাড়ি থেকে দিদিমাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা বিফল হয়। অতঃপর যথাসময়ে সাদা থান পরিহিত দুই বয়স্ক মহিলা ও একটি কিশোরীর এই দলটি চন্দননগর হাসপাতাল মাঠে ঝিনচ্যাক কিশোরকুমার নাইটস দেখতে রওনা হয়। এরপরের কাহিনীটি একটু করুণ। দিদিমারা অকুস্থলে পৌঁছতে পারেন নি। হাসপাতাল মাঠের বাইরের উত্তেজিত, বিশৃঙ্খল ভিড়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। দিদিমারা সেই ছত্রভঙ্গ জনসমুদ্রের মধ্যে থেকে কোনরকমে বেঁচে ফিরে আসেন। জেঠাইমার গায়ের শালটি খোয়া যায় এবং দিদির একপাটি চটি ছিঁড়ে যায়, ভাগ্যক্রম এছাড়া বড়সড় ক্ষতি কিছু হয়নি।


"নামে কিবা আসে যায়" এই আপ্তবাক্যটিকে দিদিমা ভীষণ রকম মেনে চলতেন।  আমার মামাতো, মাসতুতো দাদা দিদিদের তাদের ডাকনামে অর্থাৎ বিতান, বিলিন, তুতুন, বাপ্পা, বুলটাই, মনতুলি, বুবাই, টিংকু এইসব নামেই ডাকতেন বটে তবে ব্যক্তিনামের সঙ্গে ব্যক্তিকে মেলানোর কোনো চেষ্টা করতেন না। বুবাইকে বাপ্পা, বাপ্পাকে তুতুন, তুতুনকে টিংকু, টিংকুকে মন্তুলি - নামসমষ্টি থেকে কোনো একটি নাম তুলে নিয়ে আমাদের সম্বোধন করতেন।  কার দিকে তাকিয়ে বলছেন এবং কি বলছেন এ থেকে আমরা বুঝে নিতাম উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি কে। নিজের ছেলে বৌমা বা মেয়ে জামাইদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনুরূপ ছিল। তবে একটা ছক মোটামুটি মেনে চলতেন, উদ্দিষ্ট ব্যক্তি এবং উল্লিখিত নাম না মিললেও নাতিনাতনিদের ছেলেমেয়ের নামে বা জামাইদেরকে বৌমাদের নাম ধরে ডাকতেন না সচরাচর। যদিও সেরকম বিপর্যয় যে একেবারে ঘটেনি তা নয়। মায়ের জেঠতুতো দাদা, আমার সন্তুমামার স্ত্রীর নাম ছিল ইরা। এই ইরা মামিমাকে যেদিন দিদিমা নির্মল বলে ডেকেছিলেন, যা আদতে ওনার মেজো জামাইয়ের নাম, সেদিন ইরা মামিমা তো বাক্যহারা হয়ে গেছিলেন বটেই, গোটা মামারবাড়িতেই বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল।  


আমার আঠারো বছর বয়স হবার কয়েক মাস পরে, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগের দিন দিদিমা মারা যান। শৈশবের শুরু থেকে কৈশোরের শেষ দিন অবধি স্বাভাবিকভাবেই আমাকে বিভিন্ন সময় আমার সমস্ত দাদাদিদি ভাইবোনেদের নামে ডেকেছেন, আক্ষেপের বিষয় এই যে আমার নাম ধরে আমাকে তো নয়ই অন্য কাউকেও কখনো ডাকতে শুনিনি। আমার ডাকনামটিকে দিদিমা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ছিলেন। হতে পারে নামটি ওনার পছন্দ ছিল না। আমারও যে খুব সুবিধের লাগে তা নয়। আমার ডাকনামকরণের নেপথ্য নায়ক জিমি গ্রাহাম বিঙ্কস ছিলেন ইংলন্ডের ক্রিকেট খেলোয়াড়। ১৯৬৩-৬৪ তে সফররত ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের সদস্য হিসেবে ভারতে এসেছিলেন। মাত্র দুটি টেস্ট খেলার সুযোগ পান। এই সফরের সাত বছর পরে কনিষ্ঠ সন্তানের ডাকনামকরণের সময় বাবা এই জিমি বিঙ্কসকে কেন বেছে নিয়েছিলেন সেটা একটা রহস্য। সমকালীন কোনো বিখ্যাত ক্রিকেটার যেমন চাঁদু বোরদের থেকে চাঁদু বা রোহন কানহাই এর থেকে কানাই নামকরণ হলেও বোঝা যায় - তা না হয়ে মাত্র দুটি টেস্টে সুযোগ পাওয়া জিমি গ্রাহাম বিঙ্কসের নামানুসারে আমার ডাকনাম রাখা হল বিঙ্কাই।  অতি সম্প্রতি এস পি এন আর্কাইভ থেকে একটা সমাপতন অবশ্য খুঁজে পেয়েছি - ঐ সফরে কলকাতার টেস্টটি হয় ফেব্রুয়ারি মাসে এবং দুটি ইনিংসেই জিমি বিঙ্কস মাত্র ১৩ রান করে আউট হন। দুবারই সেলিম দুরানির বলে। এই অদ্ভুত ননপারফরমেন্স সাত বছর পরে, ১৩ ফেব্রুয়ারীতে আবির্ভূত আমার ডাকনামকরণকে প্রভাবিত করেছিল কিনা সেটা জানার উপায় এখন আর নেই। জিমি বিঙ্কস যদিও অষ্টাশি বছর বয়সে বেঁচেবর্তে আছেন, বাবা মারা গেছেন আট বছর হয়ে গেল। 


বাবার দেওয়া বিঙ্কাই নাম মা বদলে নেয় বিঙ্কিতে। এই নামটা তুলনামূলক বেশি পছন্দ ছিল। কারণ সে সময় ব্রিটানিয়া কোম্পানির বিঙ্কি নামের একটি বিস্কুট পাওয়া যেত। আকারে ক্ষুদ্র এবং খেতেও বিশেষ সুবিধার ছিল না তবু ইংল্যান্ডের স্বল্প পরিচিত প্রাক্তন উইকেটকিপারের থেকে বিস্কুটের সমনামে বেশি গর্ব অনুভব করতাম। বিঙ্কাই এবং বিঙ্কি দুটো নামই চালু হয়ে যায় পরিবারের মধ্যে। এর কোনটিই অবশ্য পছন্দ হয় নি আমার দুই কাকা ও কাকিমার - তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন আমাকে বিঙ্কু বলে ডাকার। ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং এর বন্ধু বঙ্কুবাবু আমার ছেলেবেলার প্রিয় হিরোদের একজন - সেই বঙ্কুর সঙ্গে ধ্বনিসাম্য থাকায় বিঙ্কু নামটিও মন্দ লাগত না।  


আঠারো বছর বয়সে ডাকনামের এক নতুন জগৎ উন্মোচিত হয় বি ই কলেজে পড়তে গিয়ে। হোস্টেল জীবনের শুরুতে র‍্যাগিং পিরিয়ডের ঝড়ঝাপটার মাঝে অল্পকিছু মজার স্মৃতি যা থেকে গেছে তার একটি হল এই ডাকনামকরণ। মূলত সিনিয়রদের উৎসাহে চেহারা, বাচনভঙ্গি, ট্র্যাডিশন, পারিপার্শ্বিকের কোনও বিশেষত্ব বা নাটকীয় কোনও মুহূর্তের সূত্র ধরে নবাগত ছাত্রদেরই অনেকরই একটি করে নতুন নাম প্রাপ্তি হতো - কলেজের চার বছর তো অবশ্যই, তার পরেও বন্ধুমহলে এই নামটিই হয়ে যায় মুল পরিচয়।  কয়েকটি চমকপ্রদ উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি 


পামেলা - কোমল, সুন্দর, শিশুসুলভ মুখের এবং ভয়ানক বিচ্ছু টাইপের অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের নাম দেওয়া হয় পামেলা। সেই সময়ের বিতর্কিত সুন্দরী একদা মিস ইন্ডিয়া পামেলা বোর্দের নামানুসারে।

চাঁচু - ভীষণ লম্বা এই সিনিয়ের আসল নাম কোনদিনই জানা হয় নি। শুধু জানতাম চাঁদে চুমু খেতে পারার মতো উচ্চতার কারণেই এই নামকরণ।

হরি - নাম অরুণ দাস, বাড়ি হরিপাল। এটা জানার পর সিদ্ধান্ত হয় বাংলা প্রবচনে বহু ব্যবহৃত হরিদাস পালের যখন সাক্ষাৎ পাওয়াই গেছে তখন তাকে হরি বলে ডাকাই ঠিক হবে। 

বি.কে. - শুনলে মনে হবে বনি কাপুর বা বিকাশ কুমার এই জাতীয় কোনও নামের আদ্যক্ষর মাত্র। আদতে সোমনাথ মুখার্জির হাবভাব এমনই কেতাদুরস্ত যে তার নাম হয়ে যায় ব্যপক কায়দা - ছোটো করে বি.কে.  

টুলু - শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম দু বছর কোনো উল্লেখযোগ্য ডাকনাম ছিল না। তৃতীয় বর্ষে মণ্ডল কমিশন পরবর্তী উত্তেজনার ভারতব্যাপী ঢেউ আছড়ে পড়ে আমাদের কলেজেও। সেই সময় শুভাসিশ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কোথা থেকে উঁচু একটি টুল যোগাড় করে, তার উপর উঠে, কলেজের ফার্স্ট লবিতে দীর্ঘ জ্বালাময়ী একটি বক্তৃতা দেয়। সেই বক্তৃতার প্রভাব খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, কিন্তু শুভাসিশের টুলু নামটি চিরস্থায়ী হয়ে যায়।    

কলেজ জীবনে এইরকম কোনো নাম আমার জোটে নি। আমার আপাতপ্রাজ্ঞ হাবভাবের কারনে এবং একটি নাটকে বৃদ্ধের চরিত্রের অভিনয় করে সামান্য খ্যাতিলাভের পরে হস্টেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে দাদু বলে ডাকতো বটে, কিন্তু নামটির বিশেষ প্রচার হয় নি, মুষ্টিমেয় কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। অতি সম্প্রতি আমার এই দুঃখ ঘুচেছে। গত ডিসেম্বরে (২০২৪) কলেজজীবনের বন্ধুদের একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমায় কিছু খাটাখাটনি করতে হয়। আমার দায়িত্ব ছিল হিসেব নিকেশের। কতজন সমাবর্তনের স্মারক পাবে, কতজন অনুষ্ঠানের দিন আসবে, কতজন রাতে থাকবে, কতজন একা আসবে বা ফ্যামিলিসহ - এইসব হিসেব রাখা আর সেই হিসেব মতো চাঁদা তোলা। দৈনন্দিন হিসাবের চুলচেরা বিচার ও তার দীর্ঘ তালিকা ক্রমাগত প্রকাশের আতিশয্যে বন্ধুরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে সিদ্ধান্তে আসে যে আমি যমরাজার সহকারী, পাপপুণ্যের হিসারক্ষক, শ্রী চিত্রগুপ্তের সমকক্ষ হয়ে উঠেছি। অনুষ্ঠানটি মিটে গেছে কিছুমাস হল। বন্ধুমহলে এখন আমাকে চিত্রগুপ্ত নামেই ডাকা হচ্ছে। 


বয়স বাড়ছে। ডাকনামে ডাকার মত বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। তবে বয়ঃকনিষ্ঠদের ডাকেও নতুন নামকরণ ঘটে যায় অনেক সময়। শিশু বয়সে বা যৌবনে পাওয়া ডাকনামগুলির পাশাপাশি বেশি বয়সে পাওয়া এই নামগুলিও ব্যক্তিপরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে কলকাতার সল্টলেকের AJ ব্লকে যখন ভাড়া থাকতে শুরু করি তখন আমার স্ত্রীর সম্পর্কের দিদি জামাইবাবু, মিঠুদি আর স্বপনদা ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী। ওনাদের বাড়ির নাম্বার AJ 209 আর আমরা থাকতাম AJ 200 নাম্বার বাড়ির একতলায়। বাড়িওয়ালা ছিলেন স্বপনদার বন্ধু, সেই সূত্রেই আমরা এই এ জে দুশোয় আসি। স্বপনদার ছোটোছেলে ঋভুর তখন পাঁচ বছর বয়স। প্রথম পরিচয়ে সে যখন জানল আমি দুশো নম্বর বাড়ির মেসোমশাই তখন সে সিদ্ধান্ত নিল যে আমাকে দুশোমেসো ডাকাই ঠিক হবে। এ জে দুশোর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এসেছি কুড়ি বছরের ওপর, যুবক ঋভুর কাছে আমি আজও সেই দুশোমেসো।  


আমার বর্তমান ঠিকানা নিউটাউন সংলগ্ন থাকদাড়ি অঞ্চলের একটি  পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলায়, ইংরিজি হিসাবে 3rd Floor. এই বাড়িরই দোতলার বাসিন্দা পাঁচ বছরের হিয়ার সঙ্গে মাঝে মধ্যে আমার সুখ দুঃখের আলোচনা হয়। ঋভুর দুশো মেসো সম্বোধনের অনুপ্রেরণায় আমি হিয়াকে বলেছিলাম আমার ফ্ল্যাট নাম্বার যখন 3D তখন সে আমাকে থ্রিডি কাকু বলে ডাকতে পারে। তারপর থেকে হিয়া আমায় সিলি(silly) কাকু বলে ডাকছে। সে শুনতে ভুল করেছিল নাকি আমার আহাম্মুকি সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়েই এই নামকরণটি করেছে সেটা আর জানার সাহস হয় নি, তবে মানতেই হবে নামকরণটি সার্থক। কিছুটা কলোনিয়াল আর কিছুটা কসমোপোলিটান সংস্কৃতিজাত “আঙ্কল” সম্বোধনের আক্রমণে কাকু, মেসোরা অনেকটাই কোণঠাসা। সম্বোধনের এইরকম আকালে দুশো মেসোর পরে এই সিলি কাকু নামপ্রাপ্তিতে আমি যারপরনাই খুশি। 


আমার ন জেঠার ছেলে বাপ্পাদাদাকে আমি ডাকি দাদামণি। দাদামণিকে খুব ছোটোবেলায় বাবা বলেছিল শুধু(মাত্র) কাকা বলে ডাকতে। দাদামণি ডাকত শুধুকাকা বলেই, “শুধু” বিশেষণ টিকে নামের অংশ হিসেবে ধরে নিয়ে। পূর্বে বর্ণিত দিদিমার নৈশ অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গিনী জেঠতুতো দিদি বয়সে এই দাদামনির থেকে চার বছরের ছোটো। অগ্রজের দেখাদেখি সেও বাবাকে শুধুকাকা এবং মাকে শুধুকাকিমা বলে ডাকতো। মায়ের আবার এই শুধুকাকিমা ছাড়াও আরও অনেক বিচিত্র নাম ছিল যেমন দুই মামাতো দাদা নাম দেয় শুন্যপিপি  যা আসলে সুন্দর পিসির অপভ্রংশ, আমার এক ভাগ্নী ডাকতো বাগদিদা - অর্থাৎ বাগবাজারের দিদা। দুই নাতি নাতনি, মানে আমার দাদার মেয়ে এবং আমার ছেলেকে, মা শিখিয়েছিল আম্মা বলে ডাকতে কারণ ঠাম্মা বললেই নাকি মনে হয় থুত্থুড়ে বুড়ি। তবে সবথেকে কৌতুকময় সম্বোধন ছিল আমার সেজ মাসির মেয়ে মন্তুলি দিদির। মায়ের ডাকনাম খুকু, মন্তুলিদি তার সঙ্গে মনি যোগ করে ডাকতো খুকুমণি বলে। এই সম্বোধনের জন্যই কিনা জানিনা, জাগতিক সমস্ত কিছুর প্রতি শিশুর মতো কৌতূহল আর নতুন কিছু শেখার উৎসাহ ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। ইউটিউব ভিডিও দেখে আশি বছর বয়সে অনলাইনে আমাজন থেকে প্লাস্টার অফ প্যারিস আর ক্লে কিনে তাই দিয়ে ফুলদানি বানিয়ে সেগুলি উপহার দেওয়ার উৎসাহের প্রাবল্যে আমরা ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম শেষ দিকে। বাড়িতে কোনো আত্মীয় স্বজন এলেই দেখা যেত ওবেলিস্কের মেনহিরের সাইজের বিশাল এক কারুকার্যমণ্ডিত ফুলদানি বগলে নিয়ে ফিরছেন। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে আচমকা চলে যাওয়ার আগের রাত্তিরেও ফুলদানির প্রোডাকশান পুরোদমে চালু ছিল। আমার নিউটাউনের ফ্ল্যাট, আমাদের চন্দননগরের বাড়ির আনাচে কানাচে ছোটো, মাঝারি, বিশাল আকৃতির ফুলদানিরা এখনও দাপটের সঙ্গে বিরাজমান।     


মায়ের মেয়েবেলা কেটেছে চন্দননগরের উত্তরে বুড়োশিবতলা অঞ্চলে। এই অঞ্চলের বিচিত্র অনেক গল্পকথা ছিল মায়ের ঝোলায়। এই রকম দুটি গল্প যার কেন্দ্রে ব্যক্তিনাম তাই দিয়েই এই অধ্যায়ের দাঁড়ি টানব। মায়ের সোনাকাকার ছেলে, যার ডাকনাম গাবু আর ভালো নাম উৎপল, সেই গাবুমামা ছোটো বেলায় একটি পদ্য শুনিয়ে পাড়ায় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। সেটি ছিল এই রকম 


আঁখি দিদি কমলা,

দুদু দিদি কমলা,

উপ মা কমলা,

প্যাঁক প্যাঁক কমলা। 


আঁখি দিদি কমলা - গাবুমামার প্রতিবেশীনি এই দিদির ডাক নাম ছিল আঁখি, ভাল নাম কমলা। 

দুদু দিদি কমলা - গাবুমামার বাড়িতে দুধ নিয়ে আসতেন কমলা নামের এই গোয়ালিনী।  

উপ মা কমলা - উৎপলের মানে গাবুমামার মা, মায়ের সোনাকাকিমার নামও ছিল কমলা। 

প্যাঁক প্যাঁক কমলা - কমলা নামের আর এক প্রতিবেশীনি যার পোষা হাঁসেরা প্যাঁক প্যাঁক শব্দে  পাড়া সচকিত করে রাখত। 


পদ্যটি গাবুমামাকে কে শিখিয়েছিল জানা নেই তবে এতগুলি কমলা নামের নারীকে আলাদা করে চিনে নিতে এর উপযোগিতা ছিল প্রশ্নাতীত। আর মা যখন সত্যিকারের খুকুমণি সেই সময়ের খেলার সাথী একটি মেয়ে হয়তো নিজে নিজেই, হয়তো বা কোনও রসিক গুরুজনের ইন্ধনে বানিয়ে ফেলেছিল ডাকনাম আর ভাল নাম মিশিয়ে আত্মপরিচয়ের একটি ক্ষুদ্র নামাবলী। তার নাম কেউ জানতে চাইলেই সে বেণী দুলিয়ে সুর করে বলে উঠত  


উকুচি,

বুকুচি,

পকালি,

স্মৃতিকণা গাঙ্গুলি 


অভিধানে নামমাত্র শব্দের অর্থ পাচ্ছি অকিঞ্চিৎকর। আমার এই কিম্ভূত জীবনও তো তাইই। এই তিপ্পান্ন বছরের দিনগত পাপক্ষয়ের পর ঝুলিতে যা পড়ে আছে তার চোদ্দ আনাই তো ফাঁকি। তবে স্মৃতির বর্মীবাক্সে যত্ন করে রাখা আছে এইসব নাম - ভক্তিসিঞ্চিত ঈশ্বরনিবেদিত নাম, প্রথাবিরুদ্ধ প্রগতিশীল নাম, আদর করে রাখা নাম, ভুল করে ডাকা নাম, বন্ধুদের বানানো নাম, না দেখা মানুষের নাম, ভুলে মনে পড়ে যাওয়া নাম, ছবি হয়ে যাওয়া নাম,  - দুর্গানারায়ণ থেকে প্যাঁক প্যাঁক কমলা, জিমি গ্রাহাম বিঙ্কস থেকে হরিদাস পাল, খুকুমণি থেকে দুশো মেসো, হাহা হিহি হুহু থেকে উকুচি বুকুচি পকালি … 


এরাই আমার সযত্নে বাঁচিয়ে রাখা বাকি দু আনা  - নাম মাত্র হয়েও নামমাত্র নয়। 


মে, ২০২৪


স্বীকারোক্তি

লেখাটি আত্মজৈবনিক এবং লেখায় ব্যবহৃত নামগুলি মধ্যে অধিকাংশই আমার আত্মীয়, স্বজন আর বন্ধুর নাম। তথ্য গোপনীয়তার কথা মাথায় রেখে যদি নাম পরিবর্তিত করতাম তাহলে লেখাটাই দাঁড়ায় না - তাই এইটুকু স্বাধীনতা নিতে হয়েছে। তাছাড়া আমার লেখার পাঠক সংখ্যা নগণ্য এবং বেশ কিছু ব্যক্তিনাম লেখায় ব্যবহৃত হয়েছে, এমতাবস্থায় নাম ব্যবহারের অনুমতি নিতে গেলে অনুমতির সংখ্যা পাঠকের সংখ্যার থেকে বেশি হয়ে যাবার সম্ভাবনা তাই সাহস করে বিনা অনুমতিতেই নামগুলি ব্যবহার করেছি।  তবে এই আখ্যান যেহেতু শুধু নাম নিয়েই এবং শুধুমাত্র ব্যক্তিনামের প্রকাশ তথ্য গোপনীয়তাকে লঙ্ঘন করে না তাই আশা রাখি উল্লিখিত ব্যক্তিরা বা তাদের অভিভাবকেরা আমার এই প্রগলভতাকে ক্ষমা করবেন।     


ঋণস্বীকার 

  1. "Ladka Tez Hai Lekin.."  Season1, Episode 7 , 3 April 2020  -  Panchayat (TV series) 

  2. Shaji to Shivshankar - Jinoy Jose P, Newsletter, Frontline weekly, Jan 30, 2024

  3. Jimmy Binks - Wikipedia (https://en.wikipedia.org/wiki/Jimmy_Binks)

  4. Jimmy Binks Profile - Espn Cricinfo (https://www.espncricinfo.com/cricketers/jimmy-binks-9095)

  5. India vs England, 1964 3rd Test Scorecard  https://www.espncricinfo.com/series/england-tour-of-india-1963-64-61794/india-vs-england-3rd-test-62941/full-scorecard


Comments


Anchor 1
bottom of page